ছেলেবেলায় আমাদের মফস্বল শহরের অনেক পুরানো দালানের ফাটল বা আস্তর, আম, শিরিষ আরও কি কি সব বিশাল বিশাল গাছে একরকম মঞ্জুরী ঝুলে থাকতে দেখতাম। তখন যে দেখতাম কালছে সবুজ পাতার ভিড়ে সে সব গাছের মগডালে বেগুনি সাদা বেনি ঝুলতে - তার ফুলগুলো যেন সবুজ মহাসাগরে একবিন্দু শিশিরের মতো চিকচিক করছে। পরে বড় হয়ে জেনেছি ওসব ফুলের লতা মঞ্জুরীকে বলে অর্কিড। লোকে বলতো পরগাছা। আরো বড় হয়ে জেনেছি ওরা আসলে পরগাছা নয়, পরাশ্রয়ি (epiphyte )
সে যাক অর্কিডে মন মেতেছে বলেই তা নিয়ে কত যে কল্প
কাহিনি আগ্রহ নিয়ে শুনেছি তার ঠিক নেই।
একটা হচ্ছে এরকম, গ্রীক পুরান বলছে -সুরার দেবতা
ব্যাক্কাস, একদিন তিনি তার প্রাসাদে জাঁকজমক এক ভোজসভার
আয়োজন করেন। সেখানে বন্ধু অর্কিসকে অমন্ত্রণ জানান তিনি। ব্যাক্কাসের প্রসাদে ছিল
অপরূপ সুন্দরীরা। তারা সব পরীর মতো দেখতে। অর্কিস তাদেরই একজনকে দেখে মুগ্ধ হয়ে
প্রেমে পড়ে। এই কথা কানে যেতেই ব্যাক্কাস প্রচন্ড রেগে যায়। তারপর অর্কিসকে কেটে
টুকরো টুকরো করে এদিক সেদিক ছিটিয়ে ফেলে দেয়।
হতভাগা অর্কিসের দেহের টুকরো যেখানেই পড়েছে সেখানেই একেকটা অদ্ভুত গাছের জন্ম হয়েছে। সে সব গাছ পৃথিবীর আর কোন গাছের মতো নয়। তাদের ফুল অন্য সব ফুলের মতো নয়। তাই সে সব গাছের নাম রাখা হয় অর্কিসের নামের সাথে মিলিয়ে “অর্কিড।”
অর্কিসের দেহের বিশেষ একটি অঙ্গ গিয়ে পড়ে সাগরের মাঝখানে। সাগরের ফেনিল ঢেউয়ের সাথে মিলে জন্ম হয় গ্রীক পুরানের আরেক দেবী আফ্রোদিতির। গ্রীক ভাষায় অফ্রোদিতি শব্দের অর্থ হলো ‘সমুদ্রোদ্ভুতা।’ তিনি প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী। এক সময় গ্রীকরা তাকে সমুদ্রের দেবী হিসেবেও পুজো করতো। রোমানরা তার নাম দেয় ভেনাস। জন্মের পর আফ্রোদিতি ধীর পায়ে সাগর থেকে উঠে আসে এবং সাগরতীরে ফ্যাফোস নগরীতে অবস্থান করে। আফ্রোদিতির সেই স্মৃতিময় নগরী ফ্যাফোস থেকেই পেডিলাম অর্কিড প্রজাতির নাম, ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ ‘পা’। ধীরে ধীরে পা থেকে চটি অর্থাৎ স্লিপার রূপ নেয়। সেখান থেকে - লেডিস স্লিপার। লেডিস স্লিপার এক আদি অর্কিডের নাম। লেডিস স্লিপারকে তাই মনে করা হয় সব অর্কিডের আদুরে কন্যা।
অর্কিসের শরীরের কোনো টুকরা বাংলাদেশে পড়েছে কিনা আমার
জানা নেই তবে এদেশের বনে-জঙ্গলে অর্কিড দুষ্প্রাপ্য নয়। যারা অর্কিড চেনেন তারা
জানেন এ ফুল আমাদের দেশের নয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচুর অর্কিড জন্মে যাকে অনেকে
পরগাছা বলে থাকেন। এরা পরগাছা নয় পরাশ্রয়ি। এরা পুরানো গাছ পাথর বা ডাল আকঁড়ে ধরে আদ্রতা শুষে
নেয়। অকির্ড নিজেই পানি, বাতাস, ধুলোবালি
ও আলো থেকে খাবার তৈরি করে। অর্কিডকে যে গাছ ধারণ করে তা মরে যায় না। এ থেকেই
প্রমাণ হয় অর্কিড পরগাছা নয়। প্রাণহীন ইটের দেয়াল, এরকম
কিছুর উপর জন্মানো উদ্ভিদকেও পরাশ্রয়ী বলে। বট, পাকুড়,
অশ্বথও কিন্তু অর্ধ-পরাশ্রয়ীর মধ্যে পড়ে।
অপরদিকে পরগাছা - যে গাছে আশ্রয় নেয় সে
গাছের সতেজতা ও বৃদ্ধির হার কমিয়ে দেয়। দুর্বল ফল ও বীজ উৎপন্ন হয়, আগা শুকিয়ে ওঠে, বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। অনেক
সময় অকালে মারা যায় গাছটি।
অর্কিডের কথা বলছিলাম। এর পরিবার বিশাল। প্রায় ৯০০ গণ এবং ৩০,০০০ এর বেশী প্রজাতি রয়েছে। আকর্ষনীয় রঙ, চমৎকার গড়ন বৈচিত্র, গন্ধ, ঔষধিগুণ, দীর্ঘস্থায়ীত্ব গুণের কারণে অর্কিডের এতো আদর।
বছর কয়েক আগে গিয়েছিলাম কক্সবাজার। দেখেছি রামুর বেশ কিছু পাহাড়ে বহু গাছের ডালে ডালে ঝুলছে রিংকোস্টাইলস, ফক্সটেইল। টেকনাফ সীমান্তবর্তী নাফ নদী ঘেঁষা নেটং পাহাড়ের জঙ্গলে প্রচুর অর্কিড জন্মে। আছে গাজীপুরের গজারী বনেও। সেগুলো ভ্যান্ডাগনের নানা প্রজাতির অর্কিড। এরকম আরো কত বাগান - অপূর্ব সব ফুল ফুটিয়ে দিনের পর দিন বন-জঙ্গল আলো করে আছে কত নাম না জানা অর্কিড।
অর্কিড স্মৃতি শেষ করবার আগে অর্কিডের জন্ম নিয়ে আরেকটা গল্প বলি। এটা আমেরিকান মিথ। এখানে অর্কিডের জন্ম কাহিনীটা আবার অন্য রকম। মেক্সিকো উপসাগরকুলে এক সময় মেজান্তলা উপত্যকায় বাস করতো টোটেনাক গোষ্ঠির লোকেরা। তারা বিশ্বাস করতো, ট্রপিক্যাল অর্কিডের জন্ম হয়েছে রাজকুমারী জানাতের রক্ত থেকে। রাজকুমারী জানাতের প্রেমিক এক যুবককে ভালবাসতো। কিন্তু রাজা তা পছন্দ করতো না। ভালবেসে জানাত সেই যুবককে বিয়ে করলে তার পিতা তাকে ত্যাগ করে এবং বনে নির্বাসন দেয়। আর রাজার হুকুমে সিপাহিরা সেই যুবকের মাথা কেটে নেয়। তারপর সেই রক্ত মাটিতে যেখানে যেখানে পড়েছেলি সেখানেই জন্মেছিল ট্রপিক্যাল অর্কিড। অর্কিডের জন্ম নিয়ে এ বিশ্বাস অনেকদিন ধরেই প্রচলিত আছে আমেরিকানদের মধ্যে।
অর্কিড ফুলের গঠন বৈচিত্র্যে বিস্মিত হয়ে প্রাচীন চীনা
দার্শনিক কনফুসিয়াস একে
‘সেরা ফুল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টাল, থিওফ্রাসটাস
আদর করে এফুলের নাম দিয়েছিলেন অর্কিস। এ নামটিই বিবর্তিত হয়ে অর্কিড হয়েছে।
অর্কিডের অনেক প্রজাতির জন্ম আমাদের এই উপমহাদেশে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন
গবেষক ও সংগ্রাহকরা অর্কিড সংগ্রহ ও তার উন্নয়নে চেষ্টা কওে যাচ্ছেন।
ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ১৯৮৯
সালে লেন পাবলিশিং কোং প্রকাশিত ‘অর্কিডস’ গ্রন্থে অর্কিডের
উদ্ভিদতাত্বিক জগতের একটি পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। গবেষনা থেমে নেই। দেখেছি আমাদের
দেশের কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউটের ফ্লোরিকালচার ডিভিশনের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিনের
পরিশ্রমে দেশের নানা অঞ্চল থেকে বিভিন্ন বুনো অর্কিড সংগ্রহ করে সেগুলো শনাক্ত
করছেন।
গবেষণা চলছে দেশ বিদেশে। সে চলুক। আমরা সাধারণ মানুষ ও সব গবেষণার বই ঘাটা আমাদের কর্ম নয়।
আমরা কেবল দেখি ফুল ফুটলে নয়ন মেলে,
তখন আমাদের বিস্ময়ের সাগর উঠে দুলে!!
হেনা সুলতানা
২০।০৮।২০২০
For more info About Orchids:
Visit my site: https://www.orchidshade.com/
Thanks to Ittefaq for Bijoy to Unicode Converter
https://www.ittefaq.com.bd/converter/




3 মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।
উত্তরমুছুন