![]() |
| ডুমুর গাছ-ফল |
টিফিনের পর আরও তিনটা ক্লাস। তারপর ছুটি। ঠিক তার আগের ক্লাসটাই কৃষি বিজ্ঞান ক্লাস। কৃষি বিজ্ঞান স্যার চলে এসেছেন ঘন্টা পড়ার সাথে সাথেই। ক্লাস শুরু হয়েছে তাও দশ মিনিট হয়ে গেছে। টেবিলের উপর আস্ত এক টব। টবে রঙ্গন ফুলের গাছ। তাতে তিন চার থোকা ফুল ফুটে আছে গাঢ় লাল। কৃষি স্যারের নির্দেশ আছে - ‘ক্লাস চলার সময় স্যার বাইরে যাই, স্যার ভিতরে আসি’ এই সব বলে ক্লাস ডিস্ট্রাব করা চলবেনা। স্যার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন আমার ক্লাসে যার যেমন
প্রয়োজন চুপচাপ বের হতে পারো, প্রয়োজন মিটে গেলে চুপচাপ ক্লাসে ঢুকবে। কিন্তু কোন ডিস্ট্রাব নয়। শানাই আর অন্তরা সেই নিয়ম মেনেই ক্লাসের বাইরে গেলো আবার ভিতরে এসে চুপচাপ বেঞ্চে বসল। তার মিনিটখানেক পরে ঢুকলো মন্টাই আর ঋতু। তারপর যেই সিটে বসতে যাবে ওমনি কৃষি স্যার হুংকার ছাড়লেন, কী ব্যাপার, তোমরা যে দেখছি আজকাল ডুমুরের ফুল হয়ে গেছো। এই দু‘দিন কোথায় ছিলে? আমরা ভাবি স্যার বোধ হয় পড়ানো ছাড়া অন্য কিছু খেয়াল করেন না। তিনি একটু আত্মভোলা মানুষ। কিন্তু প্রচুর জানেন। গাছপালা, জল-মাটি পৃথিবীর নাড়ি-নক্ষত্র সব
জানেন। আমাদের খুব প্রিয়
স্যার। স্যারও আমাদের খুব ভালবাসেন।
![]() |
| Fig Fruit |
|
|
- তোমাকে কে বললো?
- বাংলা সেকেন্ড পেপারে পড়েছি স্যার। ডুমুরের ফুল - অদৃশ্য বস্তু। বাক্যরচনা - বিয়ে করার পর তোমাকে যে আর দেখাই যায় না। একেবারে
ডুমুরের ফুল হয়ে গেলে যে।
- তুমি থামো। পন্ডিত হয়ে উঠেছো। এই বয়েসে একেবারে বিয়ে
পর্যন্ত চলে গেছো।
- কেন স্যার বাক্যরচনা ঠিক হয় নাই?
- যারা বেশী কথা বলে মানুষ তাদের বোকা বলে। বাক্যরচনা ঠিক হয়েছে। রেগে রেগে বললেন। স্যার সাধারণত এতো রাগী নন। কি জানি কেন এতো রাগ করলেন!
স্যার যতোটা গর্জে উঠে ছিলেন
ততটা বর্ষালেন না।
- কাল এক থোকা ডুমুর নিয়ে আসবে। বেশী কথা বলার জন্য
এটাই তোমার শাস্তি।
আপাতত মনে হলো শাস্তিটা
হালকা হলো। পরে বোঝা গেল কী মুশকিলের কথা! ও কোথা থেকে ডুমুর আনবে? ডুমুরের গাছই বা
কোথায় পাবে? ডুমুর চেনে কি না তাই বা কে জানে! পিপুলির কেঁদে ফেলার জোগাড়।
- স্যার আমি কোথায় ডুমুর পাবো?
চুপচাপ স্বভাবের নৈঋতা কারো
কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সে বললো, ও না পারলে আমি এনে দেবো স্যার?
- না, যার শাস্তি তাকেই ভোগ করতে হবে। বলেই স্যার ক্লাস
থেকে সব গুছিয়ে কটমট কওে বেরিয়ে গেলেন। এদিকে পিপুলিকে শান্ত¦না দিয়ে নৈঋতা বলল কিছু ভাবিস
না, আমি তোকে
সাহায্য করবো। কৃত্তিকা
জানতে চাইল আমরা কী কিছু করতে পারি?
- নারে , তোরা তো থাকিস শহর এলাকায়। এ কাজ তোরা পারবি
না।
আর এদিকে আমরা আফসোস করে
মরছি কার শাস্তি কে ভোগ করে? শাস্তি তো হওয়া উচিত ছিল ওই ফাঁকিবাজ দুটোর।
ছুটির ঘন্টা পড়ে গেছে, আর
কি কেউ দাঁড়ায়? দুদ্দাড় সব ছুট।
নৈঋতাটা আসে সেই অনেক দূর থেকে। ওদের বাড়িটা সদর পেরিয়ে অনেকটা দূরে। হাটুভাঙ্গা নদীর ধারে। বেশ কষ্ঠ করে স্কুলে আসে। চারদিক বাঁশছাড়, গাছগাছালিতে ভরা ওদের গ্রামটা । নৈঋতা গল্প করে, বিকেল ফুরাতে না ফুরাতেই সন্ধ্যা নামে। আর ওদিকে নাকি সূর্য ডুবলেই রাত। সন্ধ্যে হতেই তাদের বাড়ির কোনে ডুমুর গাছটা জুড়ে বাদুড়দের সভা বসে। কুলবরইয়ের ঝোপটার মাঝখান দিয়ে পাতকুয়োর পশ্চিম ধারে লটকন গাছটার পাশ দিয়ে নিঃশব্দ পাখা ঝাপটিয়ে এমন ভাবে তারা একসাথে এসে নামে ডুমুর গাছটার উপর যেন মনে হয় ঝটকা বাতাসে কোথা থেকে একটা কালো শাড়ি এসে পড়ল। সেই সাথে জোনাকিরা আলো দিতে থাকে। সে এক দৃশ্য হয় তখন।
ঋতুর খুব সক্কাল সক্কাল
ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস। কলতলায় দাঁত মাজতে মাজতে দেখে ডুমুরতলাটা ছেয়ে গেছে লালছে মারবেলের
মতো ডুমুরে। রাতভর সভাশেষে বাদুড়গুলো ডুমুর দিয়েই ভোজ সারে নিশ্চয়ই। যত না খায় তার
চেয়ে বেশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে। তারপর আসে বুলবুলি, বসন্তবৌরি, হরিয়াল, কাক-ককিলও। সবাই
ব্রেকফাস্ট সারে ওই ডুমুর দিয়ে। মা-ও প্রায়্ই তরকারি রাঁধে জগডুমুরের সাথে কুচোচিংড়ি
দিয়ে। বাড়ির সবাই হাত চেটে চেটে খায়, এতো মজা। নৈঋতার ছোট টুকুন এসব খেতে চায় না। কাকু
বলে খুব ভিটামিন ডুমুরে। বেশি করে খাবি। কুটে-বেছে রাখার সময় সে দেখেছে ডুমুরের পুরু
শাঁসটা দুই ভাগ হয়ে যায় একটু চাপ দিলেই। মাঝখানটা ফাঁপা। শাঁসের ভেতরের দেওয়াল থেকে
গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য শুঁড়ের এক ঝোপ।
নৈঋতা কাগজের ঠোঙ্গায় ভোরে
অনেকগুলো ডুমুর নিয়ে এসেছে আজ স্কুলে। তা দেখে শুধু পিপুলি
কেন আমরা সব্বাই খুশিতে
আটখানা। কৃষি স্যার ক্লাসে আসতেই স্যারের হাতে ডুমুরের ঠোঙ্গা তুলে দিল পিপুলি। স্যার
তো আরও খুশি। সত্যিই এগুলো পিপুলি এনেছে কিনা
সে তদন্তে না গিয়ে ঠোঙ্গা থেকে বেশ কতগুলো ডুমুর বের করে টেবিলের উপরে রাখলেন তিনি।
- বেশ বড় বড় তো! হাসি হাসি মুখে একটা হাতে নিয়ে বললেন, বুঝলে দার্জিলিংয়ে
বেড়াতে
গিয়ে একটা জায়গায় দেখেছিলাম
আপেল সাইজের ডুমুর। মাপে ছোট-বড় যাই হোক না কেন
সব ডুমুরের একই চেহারা।
পৃথিবীতে প্রায় ৭৫০ রকমের ডুমুর আছে। তবে এই যে এতো রকমের ডুমুর কিন্তু সবার মধ্যে
একটা অদ্ভুত মিল আছে।
স্যার একটা ডুমুর ভেঙ্গে
আমাদের দেখালেন। তার ভিতর থেকে অতি ক্ষুদ্র ডানাওয়ালা ঠিক পিপড়ের মতো কালো কালো পোকা
বেরিয়ে এলো। পৃথিবীর যে কোন ডুমুর ভাঙ্গলে এরকমই কিছু পোকা দেখা যাবে। এদেরকে বলে ওয়াস্পা।
এটা ইংরেজি শব্দ। আতশ কাঁচ ছাড়া এদের ভালো কওে দেখা যায় না।
- কিন্তু স্যার এই ওয়াস্পরা ডুমুরের মধ্যে কী করে?
ঢুকলোই বা কী করে? পিপুলি আসলে চুপচাপ
থাকতে পারে না। প্রশ্নের
পর প্রশ্ন করতে থাকে। স্যার অবশ্য তাতে কখনো রাগ করেন না বরং মনে মনে খুশিই হন। তিনি
আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেন। বকা দিয়ে চুপ করিয়ে দেন না।
- তার আগে বলো ডুমুর ফুল না ফল ?
- ফল , আমরা সবাই একসাথে বলে উঠলাম। হাতের ইশারায় স্যার
আমাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন আসলে দুটোই। ফলের ভিতর ফুল হওয়ার নামই ডুমুর। ফুলটি তাই দেখা
যায় না।
- সে কী করে হয়? আমাদের প্রশ্ন।
-ডুমুরের ভিতরটাই সেই ফুল। শুরুতে ফুল, বেড়ে উঠলে ফল।
চারপাশ থেকে মুড়িয়ে ফুলে শরীরে যা কিছু তার সবই এই আবরণীতে ঢেকে দিয়েছে। তাই দেখা যায় না। এ জন্যই
বলে ডুমুরের ফুল অর্থাৎ অদৃশ্য। ভাঙ্গা ডুমুরটি হাতে নিয়ে দেখালেন পুংকেশর গর্ভকেশর
সবই আছে। সেগুলোই ভেতরে সরু কেশরের মতো দেখা যা”েছ। ঘরে বাইরে সে কিন্তু নিরাপদ নয়
- ফুল যখন আছে তখন
পরাগ মিলনের কাজটিও তো হতে
হবে। সেই কাজটি করে ওই ওয়াস্পরা। কিন্তু ওরা শক্ত কৌটোর মধ্যে ঢোকে কী করে?
স্যার আমাদের হাতে হাতে
একটি করে ডুমুর দিয়ে বললেন, দেখ ডুমুরের বোটার ঠিক উল্টো
বিন্দুতে একটা অতি ক্ষুদ্র
ছিদ্র আছে। এটাই ওদের ভেতরে যাবার পথ। ডুমুর
ফুলে কিন্ত মধু
নেই। সে আশাতেও ওরা ঢোকে
না। মা-ওয়াস্পগুলো ঢোকে আসলে ফুলের ভেতরে ডিম পাড়তে। ডিম পাড়তে গিয়ে ওরা ডুমুরের ফুলে
পরাগমিলন ঘটায় নিজের অজান্তেই।
- পরাগ এলো কোথা থেকে স্যার? রূপাই প্রশ্ন করে।
- মা-ওয়াস্পও তো জন্মেছে কোন না কোন ডুমুরের ভিতর।
সেখান থেকে বেরনোর সময় পরাগ নিয়ে বের হয়। ঠিক যেমন এখান থেকে বেরিয়ে ডিম পাড়তে যাবে
অন্য কোন ডুমুরে। পৃথিবীর সমস্ত ডুমুর ওদের উপর নির্ভর করে পরাগ মিলনের জন্য। আর ওয়াস্পগুলো
ডুমুরের ভিতর ছাড়া জন্মাতে পারে না। একটা জঙ্গলে যত ডুমুর গাছ আছে তাতে পালা করে ঘুরেফিরে
ফল আসে। একবার ফল এসে গেলে একটা গাছ থেকে বেরিয়ে পরের প্রজন্মেও ওয়াস্পগুলো আরেক গাছে
গিয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়া সারা বছরই চলতে থাকে। তাই সারা বছরই ডুমুর গাছে ফল দেখা যায়।
যা বন-বাদাড়ের প্রাণীদেরও পেট ভরায় আবার সবজি হিসেবে পুষ্টির যোগান দেয় আমাদেরও। তোমাদের
তো বলেছি পোকা মাকড় আর গাছপালা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। তেমনি অদ্ভুত রকমের লড়াইও
আছে এদের মধ্যে। কিন্তু একপক্ষ ছাড়া অপর পক্ষের বাঁচা অসম্ভব। মানুষের ক্ষেত্রেও কিšু‘ এই কথা খাটে।আমাদের দেশে তিন
রকমের ডুমুর দেখা যায় -
এখানে জগডুমুরটাই বেশি পরিচিত।
এটা ২০/৩০ ফিট পর্যন্ত লম্বা হয়। স্যার তাঁর ল্যাপটপ খুলে কিছু ডুমুর গাছের ছবি দেখালেন।
এরা পত্রঝরা বৃক্ষ। এগাছের পুরু কান্ডজুড়ে ফল ধরে থাকে।
- আচ্ছা কে কে ডুমুর গাছ দেখেছো বলো তো? নৈঋতা ছাড়া
আর কেউ হাত তুলতে পারল না। আগে এগাছ খুব দেখা যেত। এখন তেমন দেখা যায় না। এক রকম বিপন্ন
হতে চলেছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার গাছ। চিন,ভারত, মায়ানমার, বাংলাদেশ এমন কি অস্ট্রেলিয়াতেও দেখা যায়। জঙ্গল
বা বনভূমির একটু স্যাঁতস্যেতে জয়গায়
এটা জন্মায়।
স্যার একটু দম নিয়ে কি যেন
ভাবলেন। হঠাৎ কি একটা মনে পড়ে যায়, তারপর বললেন, আচ্ছা ভালো কথা, তোমরা কেউ বলতে পারবে গৌতম বুদ্ধ কোন গাছের নিচে বসে ধ্যান
করে বুদ্ধত্ব লাভ করে ছিলেন? পারমী চাকমা চট করে বলল, অশ্বথ্ গাছের নিচে বসে।
- অনেক ধন্যবাদ। এই যে অশ্বথ্ গাছ, বট গাছ এরাও কিন্তু
ডুমুর গাছের শ্রেণী। এদেরও কিন্তু
ফুল দেখা যায় না। ফলের ভিতরেই পুরুষ ও নারী ফুল রয়েছে। এখানেও পিপড়াসহ সুক্ষ্ম পোকা ছিদ্র দিয়ে ফলে ফলে ঘুরে বেড়িয়ে পরাগায়ন ঘটায়। মজার ব্যাপার কী জানো,
এমনিতেই ফলটি মাটিতে পড়ে কিন্তু গাছের চারা বের হবে না। পাখি বা বন্যপ্রাণী খাওয়ার
পর মলদ্বারা নির্গত হওয়া বীজটি মাটিতে পড়ে তবেই গাছ হবে।তোমরা বলছিলে না ডুমুরের ফুল?
স্বাভাবিক ফুলের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম এই ফুল। এই বিশেষ ধরণের
ফুলকে ইংরেজিতে হাইপ্যানন্থেডিয়াম বলে। ডুমুরের পুষ্পবিন্যাসটি একধরণের রসালো ত্বকের
আবরণে ঢাকা থাকে। এই ধরণের পুষ্পবিন্যাসকে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা সাইমেস পুষ্পবিন্যাস বলে।
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো
স্যারের ক্লাস শুনছি। ততক্ষণে ছুটির ঘন্টা পড়ে গেছে। কারো মধ্যে
তাড়াহুড়ো নেই। এক সময় স্যার
স্পেসালি নৈঋতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাসতে হাসতে ক্লাস
থেকে বেরিয়ে গেলেন।




0 মন্তব্যসমূহ