কুমুদিনীতে বঙ্গবন্ধু

mujibur rahman at kumudini
 

কুমুদিনীতে বঙ্গবন্ধু

করোনা ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে পৃথিবীর মানুষের স্বস্তি। মনের অস্থিরতা  কাটাতে আমি বইয়ের আশ্রয় নিয়েছি প্রায় শুরু থেকেই। এই সংকট আসার আগে কত ব্যাস্ততা, কত কাজ, কত অজুহাত, কত এলেবেলে সময় পেরিয়ে গেছে অকারণে। সদ্য বইমেলা গেছে - নতুন নতুন বই, বইয়ের উপর বই জমে পাহাড় হয়েছে। পড়া হয়েছে মাত্র খানকতক। বাকিরা আমার ঘাড়ের উপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে।

অখন্ড অবসরে এলোমেলো বই গোছাতে গোছাতেই হাতে উঠে এল আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর।’ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে প্রায় নেশার মতো পেয়ে বসে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানির আয়োজনে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে অন্যতম আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে টাঙ্গাইল এসেছিলেন জাতির  জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময়ের ইতিহাস পড়েছি নানা বইতে। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের জন্য বাংলাদেশের প্রথম আবাসিক  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠন ভারতেশ্বরী হোমসে কাজ করার সুবাদে কাগমারীতে গিয়েছিও কয়েকবার। ১৯৫৭ সালের ৮, ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে ড. কাজী মোতাহার হেসেনের সভাপতিত্বে আওয়ামী লিগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। তিনদিন ব্যাপী এই কাউন্সিল উপলক্ষে টাঙ্গাইল পুরাতন বাস স্ট্যান্ড থেকে কাগমারী সন্তোষ পর্যন্ত ১০০ তোরণ নির্মান করা হয়েছিল। তোরণগুলির নামকরণ করা হয়েছিল - লেলিন, গান্ধী, নেতাজী এরকম আরও বহু বরেণ্য নেতাদের নামে। মৌখিক ইতিহাস শুনেছি যাদের বয়স এখন ৭৫ উর্ধ।

এই সম্মেলনের পর বঙ্গবন্ধু আরও কয়েকবার টাঙ্গাইলে এসেছিলেন। ১৯৬৭,৭০, ৭২, ৭৪ সর্ব শেষ ১৯৭৫ এর ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু কাগমারীতে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ উদ্বোধন করতে আসেন। এই কলেজ নির্মনে রণদা প্রসাদ বড় অঙ্কের অনুদান দিয়েছিলেন। এসময়ে টাঙ্গাইলবাসী তাঁকে কাছ থেকে দেখেছে। কিন্তু টাঙ্গইলের মির্জপুরের কুমুদিনী কমপ্লেক্স, সেখানকার মানুষদের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মধুর স্মৃতিগুলো এখনও অন্যরকম, অমলিন।

১৯৫৭ সালের কথাই বলি। বঙ্গবন্ধুসহ সে সময়ের আওয়ামী লীগের অনেক নেতা তখন কাগমারী সম্মেলন উপলক্ষে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর কুমুদিনী কমপ্লেক্সে রাত্রিযাপন করতেন। তখন বঙ্গবন্ধুকে যারা দেখেছেন তাদের অনেকেই এখনও জীবিত আছেন। তাদের মধ্যে মির্জাপুর গ্রামের অতুল চন্দ্র পোদ্দার। ৮৬ পেরিয়েছেন। কিন্তু স্মৃতির আয়না এখনও ঝকঝকে। - প্রতিদিনের মতো তিনি সেদিনও কুমুদিনীর পুকুর পাড়ের ফুল গাছ থেকে পুজোর ফুল তুলায় ব্যস্ত। আচমকা দেখলেন পুকুর পাড়ের পাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন এক অপরিচিত, লম্বায় চওড়ায় একেবারে চোখে পড়বার মতো। পরনে সাদা চেক লুঙ্গি, সাদা পাঞ্জাবি। ফেব্রুয়ারি মাস, বেশ ঠান্ডা। তবু সাদা চাদরটা কাঁধে জড়িয়ে আছে আলাভোলা ভাবে। কুমুদিনীর ভেতর এরকম মানুষ তো আগে কখনো দেখিনি। গ্রাম্যকিশোরের সরল সাহসে প্রশ্ন বেরিয়ে আসে

- আপনার বাড়ি কোথায়?

- গোপালগঞ্জ।

- নাম কী? কিশোরের কাঁধে মমতার হাতটি রেখে মৃদু হেসে তিনি বললেন, শেখ মুজিবুর রহমান।

তখন তো আর এতো খবরের কাগজ, টেলিভিশন আমরা দেখিনি। তাই চিনতে পারিনি। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর মুখটি ছিল পরিচিত। সরকার বিরোধী আন্দোলনের কারণে হুলিয়া বেরুলেই তিনি প্রায়ই চিকিৎসরা নামে কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতেন। সোহ্ রাওয়ার্দী সাহেবও এখানে এসে থেকেছেন। পরে জেনেছি বঙ্গবন্ধুসহ আরও অনেক নেতা কাগমারী সম্মেলন উপলক্ষে কুমুদিনী কমপ্লেক্সের রয়েল গেস্ট হাউসে (জিরো কোয়াটারে) এসেছেন। কুমুদিনীর কর্মী এরকম আরও দুজন সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন সেই পাহাড় সমান মানুষটিকে কাছ থেকে দেখবার সৌভাগ্যটুকু নিয়েই আমাদের সুখস্মৃতি!

এরপর বঙ্গবন্ধু যতবার টাঙ্গাইল এসেছেন কুমুদিনী ঘুরে গেছেন। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে তিনি দাদা সম্বোধন করতেন। দুজনের মধ্যে সম্পর্কটি ছিল আত্মিক।“অসমাপ্ত আত্মজীবনী”তে বঙ্গবন্ধু সেকথা অকাতরে স্বীকার করেছেন।

স্বপরিবারেও বঙ্গবন্ধু কুমুদিনীতে এসছিলেন। সে কথা আমারা জানতে পারি  রণদা প্রসাদ সাহা স্মারক স্বর্ণপদক প্রদান ও কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ৮৬ তম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তবে। ১৪ মার্চ ২০১৯, ভারতেশ্বরী হোমসের মাঠে শতশত ছাত্রী-দর্শকের সামনে  স্বতস্ফুর্ত ভাবে প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্মৃতিচারণে বলছেন -“সেই স্মৃতি মনে পড়ে। আর এখানে আমরা একবার এসেছিলাম, আমি খুব ছোট ছিলাম। এটা বোধহয় ‘৫৬ বা ৫৭ সালের দিকে হবে, তখন আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং আমার মা সকলেই এসে দীর্ঘসময় এখানে ছিলাম এবং স্কুল, হাসপাতাল সব ঘুরে ঘুরে দেখেছি। খুব ছায়ার মতো আমার এটুকু স্মৃতি মনে আছে। .... এই জায়গাটা এতো সুন্দর দেখে আমার বাবা বলেছিলেন যে, আমাকে এই স্কুলে ভর্তি করাবেন। হোস্টেলে  রেখে পড়ানো আমার মা‘র খুব একটা মনঃপুত ছিল না। তাছাড়া এরপরই  ’৫৮ সালে মার্শল ল জারি হয়, আমার বাবাকে জেলে নিয়ে যায়, আমাদের পড়াশুনা এমনিতেই বন্ধ।”

হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ছিলেন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রস্টের প্রথম ট্রস্টি বোর্ডের সম্মানিত সদস্য। তাঁর পরামর্শ রণদা প্রসাদ সাহার অগ্রযাত্রায় সাহস ও শক্তি যোগাত। এই মহান নেতার প্রিয়তম শিষ্য বা উত্তরসূরি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্রমে বঙ্গবন্ধুর সাথে রণদা প্রসাদের সম্পর্ক ও ঘনিষ্টতা গভীরতর হয়। তিনি রণদা প্রসাদকে দাদা সম্বোধন করতেন। তিনিও বঙ্গবন্ধুকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। স্বাধীকার সংগ্রাম চলাকালে ৭০ এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু রণদা প্রসাদের অশীর্বাদ নেয়ার জন্য নারায়নগঞ্জের কুমুদিনতে যান। বৌদি কিরণ বালা সাহা নিজ হাতে রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে আপ্যায়ন করেন। এই দুই মহান ব্যক্তিত্বের নৈকট্য কুমুদিনীতে চিরস্মরনীয় হয়ে আছে।

বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রখর স্মৃতিশক্তি। প্রচুর মানুষের নাম, জায়গার নাম মনে রাখতে পাতেন। দেশ স্বাধীন হবার পর একবার টাঙ্গাইল যাবার পথে বঙ্গবন্ধু মির্জাপুর পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে এক পথসভায় সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিচ্ছিলেন। বাস স্ট্যান্ডটি কুমুদিনীর বাউন্ডারি দেওয়াল লাগোয়া। এ সময়ে তাঁকে একনজর দেখবার জন্য অসংখ্য মানুষ ভিড় করে। দেওয়ালের উপর, বাড়ির ছাদে উঁচু গাছের মগডালেও মানুষ - সে এক এলাহি কান্ড। মির্জাপুর তো তখনও এক গন্ডগ্রাম।

বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করলেন। এদিকে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রাস্তায় শত শত জনতার চাপে ‘সি ন্ড বি’ এর দোচালা ঘরের চালটি ভেঙ্গে পড়লো  হুড়মুড় করে। চারিদিকে হৈ হৈ অবস্থা, ছুটোছুটি। বেশ ক‌’জন আহত হলো। বঙ্গবন্ধু ভাষণ থামিয়ে মাইকে বলতে লাগলেন, “ওই জ্ঞানা (কুমুদিনী হাসপাতালের সে সময়ের ওয়ার্ডবয় প্রধান জ্ঞানেন্দ্র সাহা) তুমি কোথায়? আমাদের নেতা-কর্মীদের সাহয্যে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দাও।” বঙ্গবন্ধুর সেই কিংবদন্তি কন্ঠ যতদূর পারলো ছড়িয়ে গেল দিগদিগন্তে। অবাক কান্ড! বঙ্গবন্ধুর সাথে জ্ঞানাদার পরিচয় হয়েছিল সে কথা তো রূপকথার মতো ছড়িয়ে আছে মির্জাপুর গ্রামের লোকের মুখে মুখে জ্ঞানাদার কল্যাণেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জ্ঞানাদার নাম মনে রেখেছেন এ যে গল্পকেও হার মানায়। সে গল্পে কুমুদিনীতে অবস্থান কালে বঙ্গবন্ধুকে বারকয়েক জ্ঞানাদা চা এগিয়ে দিয়ে ছিল মাত্র। এতোবছর পর রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও সে নাম তিনি মনে রেখেছিলেন?

হ্যাঁ, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান যে বঙ্গবন্ধু!

বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই এটা সম্ভব!!

ঘাতকের গুলি বঙ্গবন্ধুকে শেষ করে দিতে চেয়ে ছিল, পারেনি। তিনি মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন চিরদিন।

 

হেনা সুলতানা

শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস

মির্জাপুর, টাঙ্গাইল

১লা আগস্ট ২০২০


0 মন্তব্যসমূহ